ফর্সা হওয়ার ক্রিম । BD Today Result

ফর্সা হওয়ার ক্রিম

বর্তমান যুগে, সৌন্দর্যের ধারণা অনেকটাই ভিন্ন এবং ব্যক্তির বাহ্যিক চেহারার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচণ্ড গুরুত্ব বহন করে। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গায়ের রং নিয়ে অনেক ধরনের সামাজিক চাপ এবং বিশ্বাস রয়েছে। ‘ফর্সা হওয়ার ক্রিম’ বা ‘ফেয়ারনেস ক্রিম’ এই চাপকে কাজে লাগিয়ে বাজারে বিশাল প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এই ক্রিমগুলো শুধুই বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়াতে সক্ষম না, এর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে।

ফর্সা হওয়ার ক্রিমের ইতিহাস

ফর্সা হওয়ার ধারণাটি নতুন নয়। প্রাচীন কাল থেকেই সৌন্দর্যের অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে ফর্সা ত্বককে গুরুত্ব দেওয়া হয়। গ্রিক, রোমান ও মিশরীয় সভ্যতায় উচ্চবিত্ত নারীরা ত্বক ফর্সা রাখার জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণাটি আধুনিক যুগে এসে আরও বিস্তৃত হয় এবং ফলস্বরূপ ‘ফেয়ারনেস ক্রিম’ বা ‘ফর্সা হওয়ার ক্রিম’ প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৭৫ সালে একটি বহুজাতিক কোম্পানি প্রথম ফর্সা হওয়ার ক্রিম বাজারে নিয়ে আসে এবং তখন থেকেই এটি ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ আরও অনেক দেশে এই ক্রিমগুলোর বিপুল চাহিদা তৈরি হয়। বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখানো হয়, ফর্সা হওয়া সৌন্দর্যের প্রতীক এবং এটি আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

ফেয়ারনেস ক্রিমের রাসায়নিক উপাদান

ফেয়ারনেস ক্রিমগুলোতে সাধারণত বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো-

হাইড্রোকুইনোন

ত্বকের মেলানিন উৎপাদন কমিয়ে ফেলে, যা ত্বককে ফর্সা করে তোলে।

স্টেরয়েড

এটি ত্বকের প্রদাহ কমাতে ব্যবহৃত হয়, তবে দীর্ঘ সময় ব্যবহারে ত্বকের ক্ষতি করতে পারে।

পারদ

কিছু নিম্নমানের পারদ ব্যবহার করা হয়, যা ত্বকের কোষকে ধ্বংস করে এবং রং হালকা করে।

কোজিক অ্যাসিড

এটি ত্বকের মেলানিন উৎপাদনকে দমন করে, ফলে ত্বক ফর্সা হয়।

ফর্সা হওয়ার ক্রিমের প্রভাব

ফর্সা হওয়ার ক্রিম এর ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে অনেকেই দ্রুত ত্বক ফর্সা হওয়া এবং ত্বকের দাগ কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু এটি সাময়িক ফলাফল। ফর্সা হওয়ার ক্রিম দীর্ঘমেয়াদে ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং এর ফলে ত্বকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়।

স্বাস্থ্যঝুঁকি

ত্বকের সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি

ফেয়ারনেস ক্রিমে থাকা রাসায়নিক পদার্থগুলি ত্বককে সংবেদনশীল করে তোলে। সূর্যের আলোতে ত্বকের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি

দীর্ঘমেয়াদে ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহারের ফলে ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি, যেমন পিগমেন্টেশন, দাগ, ফুসকুড়ি, এমনকি ত্বকের রং পরিবর্তনও হতে পারে।

ক্যান্সারের ঝুঁকি

কিছু ফেয়ারনেস ক্রিমে পারদ ও স্টেরয়েডের মতো ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়, যা ত্বক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে ফর্সা হওয়ার ক্রিম হিসেবে।

অ্যালার্জি

ফর্সা হওয়ার ক্রিম উপাদানগুলি অনেক সময় ত্বকের অ্যালার্জির কারণ হতে পারে, বিশেষ করে সংবেদনশীল ত্বকের জন্য।

মানসিক প্রভাব

ফর্সা হওয়ার ক্রিম ব্যবহারের পিছনে শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও থাকে। কিন্তু যখন কোনও ব্যক্তি সমাজের চাপ বা বিজ্ঞাপনের প্রতারণায় বিশ্বাস করে যে শুধুমাত্র ফর্সা ত্বকই সফলতা বা সৌন্দর্যের চাবিকাঠি, তখন এর মানসিক প্রভাব গভীর হতে পারে। একজন ব্যক্তি যদি তার ত্বকের রং নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকে এবং ফর্সা হওয়ার ক্রিম ব্যবহার করেও কাঙ্ক্ষিত ফল না পায়, তবে হতাশা, কম আত্মবিশ্বাস, এমনকি বিষণ্ণতার শিকার হতে পারে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশে, ফর্সা ত্বককে নিয়ে একটি সামাজিক প্রথা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিবাহের ক্ষেত্রে, মেয়েদের ফর্সা ত্বক থাকা যেন অত্যাবশ্যক একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি কর্মক্ষেত্রেও ফর্সা ত্বককে অনেক সময় পেশাদারিত্বের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়, যা পুরোপুরি অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক।

বিজ্ঞাপনগুলির মাধ্যমে আরও বেশি করে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ফর্সা হওয়া মানেই সফলতা। এসব বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, একটি ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহারের পর জীবন বদলে যায় চাকরি পাওয়া সহজ হয়, বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, এবং সমাজে সম্মান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই ধারণাগুলি একধরনের সামাজিক বৈষম্য ও আত্মবিশ্বাসের ক্ষতি করে।

বিকল্প ধারণা

স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে সম্মান জানানো বর্তমান সময়ে সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা বদলাচ্ছে। অনেকেই এখন বুঝতে পারছে যে ত্বকের প্রকৃত রং যেমনই হোক না কেন, সেটিই একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক সৌন্দর্য। বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগে ‘বর্ণবৈষম্য’এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠছে। এখন সমাজে ফর্সা হওয়ার ক্রিম নেতিবাচক দিক এবং ত্বকের প্রকৃত রঙের প্রতি সম্মান দেখানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন নামকরা ব্র্যান্ড এখন আর ‘ফেয়ারনেস ক্রিম’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘স্কিন ব্রাইটেনিং’ বা ‘গ্লোয়িং স্কিন’ শব্দ ব্যবহার করছে, যা ব্যক্তির ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সহায়ক হলেও রং পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নয়।

ত্বকের যত্নে প্রাকৃতিক পদ্ধতি

ত্বক ফর্সা করার জন্য রাসায়নিক উপাদানের উপর নির্ভর না করে, কিছু প্রাকৃতিক উপায়ে ত্বকের উজ্জ্বলতা এবং স্বাস্থ্য ধরে রাখা যায়। যেমন:

নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার করা

ত্বককে ময়লা ও দূষণ থেকে মুক্ত রাখার জন্য নিয়মিত মুখ পরিষ্কার করা উচিত।

সানস্ক্রিন ব্যবহার করা

সূর্যের তাপ থেকে ত্বক রক্ষা করতে নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত।

পানি পান করা

ত্বককে আর্দ্র রাখার জন্য প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত।

ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া

ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।

সারমর্ম

ফর্সা হওয়ার ক্রিম শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতিফলন নয়, এটি একটি সমাজের সৌন্দর্যবোধ ও মানসিকতার প্রতিফলন। এটি ত্বকের রং পরিবর্তনের সঙ্গে আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর একটি প্রচেষ্টা হতে পারে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। তাই, ফর্সা হওয়ার চেয়ে ত্বকের স্বাস্থ্য ও স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। ত্বকের রঙ যেমনই হোক না কেন, সঠিক যত্ন নিলে ত্বক উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর থাকবে, যা প্রকৃত সৌন্দর্যের চাবিকাঠি।

ক্রিম মেখে কি সত‍্যি ফর্সা হওয়া যায় জেনে নিন?

মুখ সুন্দর করার উপায় জেনে নিন?

Leave a Comment