মানসিক রোগের কারণ | BD Today Result




মানসিক রোগের কারণ

মানসিক রোগের কারণ

মানসিক রোগের কারণ বা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হল এমন এক ধরণের অবস্থা যা আমাদের চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি, আচরণ, ও বোধশক্তিকে প্রভাবিত করে। মানসিক রোগের কারণ অনেক এবং জটিল, যা একজন ব্যক্তির জীবনের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিভিন্ন দিক থেকে আসতে পারে। আধুনিক সমাজে এই বিষয় নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও অনেক সময়ে মানসিক সমস্যাগুলো অবহেলা করা হয়। মানসিক রোগের মূল কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা করব।

জেনেটিক বা বংশগত কারণ

বেশ কিছু মানসিক রোগের কারণ বংশগত কারণেও হতে পারে। মানসিক রোগের ইতিহাস যার পরিবারে রয়েছে, তারও সেই একই ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ, স্কিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, এবং বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন) এর মতো মানসিক রোগগুলো প্রায়ই বংশগত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, জিনগত ফ্যাক্টরগুলোর কারণে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা ঘটতে পারে, যা মানসিক রোগের কারণ এর জন্য দায়ী।

মস্তিষ্কের রাসায়নিক অসামঞ্জস্য

মানসিক রোগের কারণ আরেকটি বড় কারণ হল মস্তিষ্কে কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিকের (নিউরোট্রান্সমিটার) ভারসাম্যহীনতা। নিউরোট্রান্সমিটার হল মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ডোপামিন, সেরোটোনিন এবং নোরএপিনেফ্রিনের মতো রাসায়নিকগুলো আমাদের মুড, আচরণ ও চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই রাসায়নিকগুলোর ঘাটতি বা অতিরিক্ততা দেখা দেয়, তখন তা মানসিক রোগের কারণ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, সেরোটোনিনের ঘাটতি বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগের জন্য দায়ী হতে পারে, এবং ডোপামিনের অতিরিক্ততা স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে।

মানসিক আঘাত ও শারীরিক নির্যাতন

শিশুদের সময়ে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন, অযত্ন বা অবহেলা তাদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদী মানসিক রোগের কারণ সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। শৈশবে ঘটে যাওয়া ট্রমা বা আঘাতের প্রভাব প্রায়ই জীবনের পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগের দিকে নিয়ে যায়। এই ধরনের অভিজ্ঞতা একজন ব্যক্তির মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে এবং বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, পিটিএসডি (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে।

শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার প্রভাব

শারীরিক অসুস্থতা বা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা প্রায়ই মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। কিছু রোগ, যেমন ক্যান্সার, হার্ট ডিজিজ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগগুলো দীর্ঘমেয়াদী স্ট্রেস সৃষ্টি করে যা মানসিক সমস্যার জন্ম দিতে পারে। শারীরিক অসুস্থতা থেকে মানসিক চাপ বা ব্যথা একজন ব্যক্তির জীবনের মান কমিয়ে দেয় এবং তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। তাছাড়াও, মস্তিষ্কের আঘাত বা আঘাতজনিত রোগও মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।

মাদক ও অ্যালকোহলের অপব্যবহার

মাদক এবং অ্যালকোহল মানসিক রোগের বড় একটি কারণ। যেসব ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে মাদক বা অ্যালকোহলের অপব্যবহার করেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অ্যালকোহল এবং মাদকের নির্ভরতা মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে বদলে দেয় এবং মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়। ড্রাগ অ্যাডিকশন বা অ্যালকোহলিক ডিপেনডেন্স থেকে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, এবং অন্যান্য মানসিক রোগের কারণ এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের সমস্যা

মানসিক রোগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের সমস্যা। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বাল্যবিবাহ, দাম্পত্য কলহ, বিচ্ছেদ, আর্থিক সংকট, এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানসিক রোগের জন্ম দিতে পারে। সম্পর্কের অবনতি এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অনেক সময়ে মানুষকে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের দিকে ঠেলে দেয়।

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও স্ট্রেস

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যেমন নতুন কাজের চাপ, শিক্ষাজীবনের চাপ, নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা, প্রিয়জনের মৃত্যু বা সম্পর্কের বিচ্ছেদ ইত্যাদি মানসিক স্ট্রেস সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিগুলো মানসিক ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী মানসিক রোগের কারণ এর দিকে নিয়ে যেতে পারে।

হরমোনগত পরিবর্তন

মানসিক স্বাস্থ্য হরমোনের পরিবর্তনের ওপরও নির্ভরশীল। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থা, মেনোপজ বা মাসিক চক্রের পরিবর্তনের সময় মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাবিত হতে পারে। অনেক নারী প্রসবের পর পর বিষণ্ণতায় ভুগে থাকেন, যাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলা হয়। হরমোনগত এই পরিবর্তনগুলো মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে এবং মানসিক রোগের কারণ এর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

পরিবেশগত কারণ

পরিবেশ মানসিক রোগের কারণ এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দূষিত পরিবেশ, দূষিত খাদ্য ও পানি, বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা এবং জীবনযাপনের নিম্নমান মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। তাছাড়া, যারা দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন, তাদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। দারিদ্র্যের কারণে চাপ এবং উদ্বেগ বৃদ্ধি পায় যা মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়।

আধুনিক জীবনের চাপ

আধুনিক জীবনের দ্রুতগতি, প্রযুক্তির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারও মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা, নেতিবাচক মন্তব্য বা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া একজনের আত্মবিশ্বাসে আঘাত করতে পারে এবং বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতে পারে।

সর্বশেষ

মানসিক রোগের কারণ গুলো অত্যন্ত জটিল এবং একাধিক কারণ একসাথে কাজ করতে পারে। ব্যক্তির জীবনের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তবে সচেতনতা, সঠিক চিকিৎসা, এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা মানসিক রোগের প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

মানসিক রোগসংক্রান্ত প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও বাস্তবতা জেনে নিন?

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায় জেনে নিন?

Leave a Comment